হিন্দুধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মসমূহের অন্যতম।
‘হিন্দু' শব্দের উৎপত্তি পারসিকদের দ্বারা। বর্তমান ইরানের প্রাচীন নাম ছিল পারস্য। পারস্যের অধিবাসীরাই ছিলেন পারসিক। তাঁরা ‘স’-এর স্থলে ‘হ’ উচ্চারণ করতেন। তাই তাঁরা উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধু অঞ্চল দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশের সময় সিন্ধুকে বলতেন হিন্দু। এ থেকে ভারতবর্ষের এক নাম হয় হিন্দুস্থান। হিন্দুস্থানের অধিবাসীদের নাম হয় হিন্দু। আর তাদের ধর্মের নাম হয় হিন্দুধর্ম ।
হিন্দুধর্মের প্রাচীন নাম সনাতন ধর্ম। ‘সনাতন' শব্দের অর্থ চিরন্তন, চিরস্থায়ী, নিত্য। যা ছিল, আছে ও থাকবে তা-ই সনাতন। কতিপয় চিরন্তন ভাবনা-চিন্তার উপর ভিত্তি করে এ ধর্মের উৎপত্তি। তাছাড়া হিন্দুধর্ম নির্দিষ্ট কোনো সময়ে একক কারো দ্বারা প্রবর্তিত নয়। একাধিক মুনি-ঋষির সমন্বিত চিন্তার ফল এটি। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর আচার-আচরণগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তবে মৌলিক তত্ত্বের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ অর্থেও এ ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলা হয়। সুতরাং সনাতন ধর্মেরই আরেক নাম হিন্দুধর্ম।
হিন্দুধর্মকে বৈদিক ধর্মও বলা হয়। কারণ বেদ হিন্দুধর্মের মূল ভিত্তি। বেদের দুটি অংশ। প্রত্যেক অংশকে বলা হয় কাণ্ড। বেদ দুটি অংশে বা দুই কাণ্ডে বিভক্ত জ্ঞানকাণ্ড - ও কর্মকাণ্ড। জ্ঞানকাণ্ডের বিষয়বস্তু হচ্ছে ব্রহ্ম সম্পর্কে জ্ঞান। ব্রহ্ম নিরাকার। আবার আত্মারূপে তিনি সকল জীবের মধ্যে বিরাজমান ।
কর্মকাণ্ডে আছে বিভিন্ন যাগ-যজ্ঞের কথা। বৈদিক যুগে প্রধান ধর্মীয় ক্রিয়া-কর্ম ছিল যাগ-যজ্ঞ। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে যাগ-যজ্ঞ করা হতো। ব্রহ্মের বিভিন্ন শক্তিকে লক্ষ করে মুনি- ঋষিরা বিভিন্ন দেব-দেবীর কল্পনা করেছিলেন। যেমন— ইন্দ্র, বরুণ, যম, মিত্র, ঊষা প্রভৃতি। বৈদিক দেব-দেবীরা ছিলেন নিরাকার। তাঁদের কোনো মূর্তি গড়া হতো না। যজ্ঞে এসব দেব-দেবীদের আহ্বান করা হতো। প্রথমে তাঁদের প্রশংসা করা হতো। পরে তাঁদের নিকট কাম্য বস্তু প্রার্থনা করা হতো। যজ্ঞের ফলে মানুষ পুণ্য অর্জন করত এবং তাতে স্বর্গলাভও ঘটত।
নিচের ছকটি পূরণ করি:
১। বেদের দুটি কাণ্ড | |
২। তিনজন বৈদিক দেবতার নাম | |
৩। হিন্দুধর্মের আরও দুটি নাম |
বৈদিক যুগের পরে আসে পৌরাণিক যুগ। এ সময় মানুষ যাগ-যজ্ঞের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে পূজা-পার্বণ করতে থাকে। তখন অনেক নতুন দেব-দেবীর আবির্ভাব ঘটে। যেমন ব্রহ্মা, দুর্গা, কালী, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি। বিভিন্ন পুরাণে এঁদের বর্ণনা আছে। সেই অনুযায়ী এঁদের মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হয়। পূজার মধ্য দিয়ে এঁদের কাছে জীবনে সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধি ইত্যাদি কামনা করা হয় ৷
আধুনিক যুগে এসব দেব-দেবীর পূজার্চনার পাশাপাশি বিভিন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব ও তিরোধান দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। যেমন- শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ, লোকনাথ ব্রহ্মচারী, প্রভু জগদ্বন্ধু, হরিচাঁদ ঠাকুর, মা সারদা দেবী, মা আনন্দময়ী প্রমুখের জন্ম ও মৃত্যু দিবস উপলক্ষে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এছাড়া নামকীর্তন, তীর্থভ্রমণ, তীর্থস্নান এসবের মাধ্যমেও ধর্মচর্চা করা হয় ।
নিত্যকর্ম ধর্মচর্চার একটি অঙ্গ। ধর্মচর্চা করতে গেলে শরীর ও মন সুস্থ থাকতে হয়। নিত্যকর্মের ফলে শরীর ও মন সুস্থ থাকে। এজন্য প্রতিদিন নিয়ম মেনে কিছু কর্ম করতে হয়। তাকেই বলে নিত্যকর্ম। নিত্যকর্ম ছয় প্রকার, যথা প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্ণকৃত্য, মধ্যাহ্নকৃত্য, অপরাহ্ণকৃত্য, সায়াহ্নকৃত্য ও রাত্রিকৃত্য।
প্রাতঃকৃত্য : সূর্যোদয়ের কিছু আগে ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর বিছানায় বসে পূর্ব বা উত্তরমুখী হয়ে ঈশ্বর বা দেব-দেবীর স্মরণ করে মন্ত্র পাঠ করতে হয়।
পূর্বাহ্ণকৃত্য : প্রাতঃকৃত্যের পরে এবং মধ্যাহ্ন বা দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে-সকল কাজ করা হয় তা-ই পূর্বাহ্ণকৃত্য। এ সময় প্রার্থনা ও পূজা করে দিনের অন্যান্য কাজ-কর্ম করতে হয়।
মধ্যাহ্নকৃত্য : দুপুরের কাজ খাওয়া ও বিশ্রাম। এটাই মধ্যাহ্নকৃত্য।
অপরাহ্ণকৃত্য : দুপুরের পর এবং সায়াহ্নের পূর্ব পর্যন্ত যে কাজ করা হয় তাকেই বলে অপরাহ্ণকৃত্য। এ সময় খেলাধুলা, ব্যায়াম বা ভ্রমণ করলে শরীর ভালো থাকে।
সায়াহ্নকৃত্য : সায়াহ্ন মানে সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকালে হাত, পা ও মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হতে হয়। তারপর ঈশ্বরের উপাসনা করতে হয়।
রাত্রিকৃত্য : সন্ধ্যার পর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজকে বলে রাত্রিকৃত্য। এ সময় অধ্যয়ন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ করা হয়। রাতের আহার গ্রহণ করতে হয়। তারপর ভগবানের এক নাম ‘পদ্মনাভ' বলে ঘুমাতে হয়।
নিত্যকর্মের ফলে নিয়মানুবর্তিতা শেখা যায়। সময়ের কাজ সময়ে করা যায়। কোনো কাজই অসমাপ্ত থাকে না। শরীর-মন ভালো থাকে। যে কোনো কাজে পুরোপুরি মনোযোগ দেওয়া যায়। মানুষের প্রতি প্রীতি জন্মে। ঈশ্বরের প্রতিও ভক্তি আসে। অতএব, আমরা সবাই নিয়মিত নিত্যকর্ম করব।
হিন্দুধর্ম আত্মায় বিশ্বাস করে। প্রত্যেক জীবের মধ্যে আত্মা আছে। সেই আত্মা অমর অর্থাৎ আত্মার মৃত্যু নেই। মৃত্যু আছে দেহের। দেহ জীর্ণ বা পুরাতন হলে তার মৃত্যু ঘটে। আত্মা তখন নতুন দেহ ধারণ করে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন :
বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় '
নবানি গৃহাতি নরোংপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা–
ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ৷৷
(২/২২)
অর্থাৎ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও তেমনি জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর ধারণ করে।
আত্মার এই নতুন শরীর ধারণ করাকেই বলে জন্মান্তর। অর্থাৎ মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত জীবাত্মা পুনঃপুন জন্মগ্রহণ করে।
এই জন্মান্তরের সঙ্গে কর্মফলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। কর্মফল মানে কর্মের ফল। যেমন কর্ম তেমন ফল। ভালো কর্ম করলে ভালো ফল। খারাপ কর্ম করলে খারাপ ফল। জীব এ জন্মে যেমন কর্ম করবে, সেই অনুযায়ী তার পরবর্তী জন্ম হবে। ভালো কর্ম করলে ভালো জন্ম হবে। খারাপ কর্ম করলে খারাপ জন্ম হবে। আবার এ জন্মের ফল আগামী জন্মে তাকে ভোগও করতে হবে। তাই আমরা সবসময় ভালো কর্ম করব। তাহলে তার ফল ভালো হবে।
পাপ হচ্ছে খারাপ কাজের ফল। আর পুণ্য হচ্ছে ভালো কাজের ফল। জীবহত্যা, পরনিন্দা, পরচর্চা, পরের ক্ষতি করা, মিথ্যা বলা, হিংসা করা ইত্যাদি হচ্ছে খারাপ কাজ। এর ফলে পাপ হয়। আর জীবে দয়া, পরনিন্দা না করা, পরচর্চা না করা, পরের উপকার করা, মিথ্যা না বলা ইত্যাদি হচ্ছে ভালো কাজ। এর ফলে পুণ্য হয়। যাঁরা পুণ্য অর্জন করেন, মৃত্যুর পর তাঁরা স্বর্গে যান। স্বর্গে অনন্ত সুখ। সেখানে রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি কিছুই নেই। স্বর্গ দেবতাদের বাসস্থান। ইন্দ্র দেবতাদের রাজা। তাঁর রাজধানীর নাম অমরাবতী। জীব কিন্তু স্বর্গে স্থায়ীভাবে থাকতে পারে না। অর্জিত পুণ্য শেষ হলে তাকে আবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হয়।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
১। খারাপ কাজের ফল | |
২। ভালো কাজের ফল |
নরক হচ্ছে ভীষণ কষ্টের জায়গা। মৃত্যুর পর পাপীরা নরকে যায়। নরকের বিভিন্ন ভেদ আছে। যেমন- তামিস্র, অন্ধতামিস্র, রৌরব ইত্যাদি। পাপের কমবেশি অনুযায়ী পাপীদের এসব নরকে পাঠানো হয়। যে যেমন পাপ করে, তার তেমন শাস্তি হয়। পাপের ফলভোগ শেষ হলে পাপী নরক-যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে। এরপর পৃথিবীতে এসে কর্মফল অনুযায়ী তার আবার নতুন জন্ম হয়।
‘মোক্ষ’ শব্দের অর্থ মুক্তি। জন্মান্তর বা পুনর্জন্মের আবর্ত থেকে ঈশ্বর বা পরমাত্মা বা পরম ব্রহ্মের সঙ্গে জীবাত্মার মিলনই হলো মুক্তি বা মোক্ষ। আর জগতের কল্যাণ হলো জগতের সকল জীবের মঙ্গল করা। কেবল নিজের কল্যাণ নয়, জগতের সকলের কল্যাণ করতে হবে- এটা হিন্দুধর্মের একটি প্রধান আদর্শ ।
আগেই বলেছি যে, কর্মফল ভোগ করার জন্য জীবের জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম হয়। এই কর্ম হচ্ছে দুই রকমের সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম। সকাম কর্ম হলো ফলভোগের আশা করে যে কর্ম করা হয় তা। এরূপ কর্ম যে করে তাকে বারবার জন্ম নিতে হয়। আর নিষ্কাম কর্ম হলো ফলভোগের আশা না করে যে কাজ করা হয় তা। এই নিষ্কাম কর্ম যিনি করেন, তিনি এক সময় মুক্তি বা মোক্ষলাভ করেন। জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে পরম ব্রহ্মের সঙ্গে চিরতরে লীন হয়ে যান। এই চিরমুক্তি বা মোক্ষলাভই হিন্দুধর্মের মূল লক্ষ্য।
যাঁরা মোক্ষলাভ করতে চান, তাঁরা কখনো অপরের ক্ষতি করেন না। তাঁরা কাউকে হিংসা করেন না। কারো বিরুদ্ধে তাঁদের কোনো বিদ্বেষ থাকে না। ব্রহ্মজ্ঞানে তাঁরা সবাইকে ভালোবাসেন। নিজের ক্ষতি হলেও অপরের উপকার করেন। সবাইকে আপনার মনে করেন। তাঁদের কোনো লোভ-মোহ থাকে না। ফলে জগতে কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না। মারা- মারি, হানা-হানি থাকে না। সর্বত্র অখণ্ড শান্তি বিরাজ করে। এতে জগতের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হয়।
শিক্ষার্থীর কাজ : শিক্ষার্থী দৈনন্দিন জীবনে অনুসরণীয় নিত্যকর্মের একটি তালিকা তৈরি করবে এবং সে তালিকা পড়ার টেবিলের সামনে টাঙিয়ে রাখবে, যাতে সবসময় চোখে পড়ে এবং অনুসরণ করতে পারে।
১। ___ বিষয়বস্তু হচ্ছে ব্রহ্ম।
২। পৌরাণিক যুগে অনেক নতুন ___ আবির্ভাব ঘটে।
৩। প্রতিদিন নিয়ম মেনে যে কাজ করা হয় তাকে বলে ___।
৪। নিত্যকর্মের ফলে ___ শেখা যায়।
৫৷ ___ রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি কিছুই নেই।
৬। যাঁরা মোক্ষলাভ করতে চান তাঁরা ___ সবাইকে ভালোবাসেন ।
১। হিন্দুধর্মের আরেক নাম ২। বৈদিক দেব-দেবীরা ছিলেন ৩। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, দুর্গা, কালী প্রভৃতি ৪। নিত্যকর্মের ফলে যে কোনো কাজে পুরোপুরি ৫। আত্মার জীর্ণদেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করাকে বলে ৬। অর্জিত পুণ্য শেষ হলে জীবকে ৭। জন্ম-মৃত্যুর আবর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে জীব পরম ব্রহ্মে | লীন হয় । সনাতন ধর্ম। নিরাকার। পৌরাণিক দেবতা। মনোযোগ দেওয়া যায়। নবজন্ম। পুনর্জন্ম লাভ করতে হয়। জন্মান্তর। অশেষ ক্ষমতাধর । |
১। ‘সনাতন' শব্দের অর্থ কী?
২। চারজন বৈদিক দেবতার নাম লেখ ।
৩। নিত্যকর্ম কয়প্রকার ও কী কী?
৪। জন্মান্তর কাকে বলে?
৫। ভালো কাজ কী? তার ফলে কী হয় ?
৬। মোক্ষ কাকে বলে ?
১। হিন্দুধর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ।
২। বেদের কয়টি কাণ্ড? এ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
৩। পৌরাণিক যুগের হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বর্ণনা কর ।
৪। নিত্যকর্ম কী? যে কোনো তিনটি নিত্যকর্মের বর্ণনা দাও ।
৫। জন্মান্তর কাকে বলে? এ সম্পর্কে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
৬। পাপ-পুণ্য ও স্বর্গ-নরক বলতে কী বোঝ?
৭। মোক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর।
আমরা জানি যে, ধর্মগ্রন্থে থাকে ধর্মের কথা। ঈশ্বরের কথা। দেব-দেবীর উপাখ্যান। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে নানা উপদেশ। তাই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে আমাদের কল্যাণ হয়।
হিন্দুদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদ বা বেদসংহিতা। এছাড়া আছে উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চণ্ডী প্রভৃতি। এর আগে আমরা রামায়ণ ও মহাভারত সম্পর্কে জেনেছি। এখন জানব বেদসংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ, পুরাণ ও গীতা সম্পর্কে।
বেদসংহিতা : বেদ ঈশ্বরের বাণী। বিভিন্ন মুনি-ঋষি এই বাণীসমূহ দর্শন করেছেন। সেগুলো লিপিবদ্ধ করে সংহত করেছেন। তাই এর নাম হয়েছে সংহিতা বা বেদসংহিতা। বেদ প্রথমে একটিই ছিল। পরে ব্যাসদেব এর মন্ত্রগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেন। ফলে বেদ হয়ে যায় চারটি। চারটি বেদ হলো : ঋগ্বেদ সংহিতা, যজুর্বেদ সংহিতা, সামবেদ সংহিতা ও অথর্ববেদ সংহিতা।
ঋগ্বেদ সংহিতা - এতে রয়েছে দেবতাদের স্তুতি ও প্রার্থনামূলক মন্ত্র। এগুলো পদ্যে - রচিত এক ধরনের কবিতা।
যজুর্বেদ সংহিতা- এতে যে মন্ত্রগুলো রয়েছে সেগুলো যজ্ঞের সময় উচ্চারণ করা হয় ।
সামবেদ সংহিতা - এর মন্ত্রগুলো গানের মতো। দেবতাদের উদ্দেশে এগুলো সুর দিয়ে গাওয়া হয় ।
অথর্ববেদ সংহিতা - এতে চিকিৎসা বিজ্ঞান, বাস্তুবিদ্যা (গৃহ নির্মাণ) ইত্যাদিসহ জীবনের - অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
বেদের এক নাম শ্রুতি। এর কারণ, অতীতে শিষ্যরা গুরুর কাছ থেকে শুনে শুনে বেদ মনে রাখতেন। তাই এর এক নাম হয়েছে শ্রুতি। বেদের দুটি অংশ মন্ত্র ও ব্রাহ্মণ।
মন্ত্র : বেদের যে অংশ পদ্যে রচিত এবং বিভিন্ন দেবতার প্রশংসা, স্তুতি ও প্রার্থনা করা হয়েছে, তাকেই মন্ত্র বলা হয়েছে। যেমন— ঋগ্বেদের শ্লোকসমূহ।
ব্রাহ্মণ : যে অংশে মন্ত্রের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং যজ্ঞে মন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে,তাকে বলে ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ গদ্যে রচিত। ঐতরেয়, কৌষীতকি,শতপথ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থ।
আরণ্যক : যা অরণ্যে রচিত তা আরণ্যক। এর বিষয় ধর্ম-দর্শন। এতে যজ্ঞের চেয়ে সৃষ্টির রহস্য, সৃষ্টির উৎস প্রভৃতি আধ্যাত্মিক বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে। ঐতরেয়, কৌষীতকি, শতপথ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য আরণ্যক।
উপনিষদ : এর আলোচ্য বিষয় ব্রহ্ম। ব্রহ্মের আরেক নাম পরমাত্মা। তিনি নিরাকার। প্রত্যেক জীবের মধ্যে তিনি বর্তমান। তাকে বলে জীবাত্মা। এ অর্থে জীবও ব্রহ্ম। ব্রহ্মই সবকিছুর মূলে। তাই উপনিষদে ব্রহ্ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ঈশ, কেন, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য উপনিষদ।
পুরাণ : ‘পুরাণ' শব্দটির সাধারণ অর্থ প্রাচীন। কিন্তু এখানে শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। যে ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টি ও দেবতার উপাখ্যান, ঋষি ও রাজাদের বংশ-পরিচয় প্রভৃতি আলোচনা করা হয়েছে, তাকে বলে পুরাণ। এসবের মাধ্যমে বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে।
পুরাণ একটি নয়, অনেকগুলো। মূল পুরাণ ১৮টি। উপপুরাণ ১৮টি। এগুলোর রচয়িতা ব্যাসদেব। কয়েকটি মূল পুরাণ হলো ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, শিবপুরাণ, অগ্নিপুরাণ ইত্যাদি। আর কয়েকটি উপপুরাণ হলো নরসিংহপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ ইত্যাদি।
পুরাণের মধ্যে তিনজন দেবতার মাহাত্ম্য প্রধানভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁরা হলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। দুর্গা ও কালীর বর্ণনা আছে যথাক্রমে দেবীপুরাণ ও কালিকাপুরাণে ।
গীতা : গীতার পুরো নাম শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। এটি মহাভারতের ভীষ্মপর্বের একটি অংশ। এতে ১৮টি অধ্যায় আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে বিপক্ষে আত্মীয়-স্বজনদের দেখে অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইলেন না। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে অনেক উপদেশ দেন। সেটাই গীতা। গুরুত্বের কারণে এটি পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে।
গীতায় সব রকমের দুর্বলতা পরিহার করতে বলা হয়েছে। ঈশ্বরের নামে সকল কর্ম করতে বলা হয়েছে। ফলের আশা না করে। একেই বলে নিষ্কাম কর্ম। আত্মার অমরত্বের কথা বলা হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বার কথা বলা হয়েছে। শ্রদ্ধাবান ও সংযমীরাই জ্ঞান লাভ করেন একথা বলা হয়েছে। গীতা হচ্ছে সব শাস্ত্রের সার। তাই এটি হিন্দুদের একখানা অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ।
আমাদের ধর্মগ্রন্থসমূহে অনেক উপাখ্যান আছে। সেসব উপাখ্যানের মাধ্যমে ধর্ম, দর্শন, নৈতিকতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এখানে ভাগবতপুরাণ থেকে হরিভক্ত ধ্রুবের উপাখ্যানটি তুলে ধরা হলো :
অনেক কাল আগের কথা। উত্তানপাদ নামে এক রাজা ছিলেন। তাঁর ছিলেন দুই রানি - সুনীতি ও সুরুচি। সুনীতি বড়, সুরুচি ছোট। সুনীতির পুত্র ধ্রুব, সুরুচির পুত্র উত্তম। ছোট রানি সুরুচি ছিলেন রাজার প্রিয়। তাই তাঁর পুত্র উত্তম পিতার কাছে বেশি আদর পেত ।
একদিন উত্তম পিতার কোলে বসে আছে। তা দেখে ধ্রুবও পিতার কোলে উঠতে যায়। ঠিক তখনই সুরুচি এসে বাধা দেন। এতে ধ্রুব খুব কষ্ট পেল। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে সব বলে দিল। মা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘কেঁদো না। হরিকে ডাক। তিনি তোমার সকল কষ্ট দূর করে দেবেন।
ধ্রুব মাকে খুব শ্রদ্ধা করত। তাই মায়ের আদেশ অনুযায়ী সে হরিকে ডাকতে লাগল। একদিন সে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। পথে যাকে দেখে তাকেই হরির কথা জিজ্ঞেস করে। এভাবে হরিনাম করতে করতে সে এক গভীর বনে ঢুকে পড়ল। তার মুখে হরিনাম শুনে বনের পশুরাও হিংসা ভুলে গেল ৷
ধ্রুব একমনে হরিকে ডেকেই চলেছে। অন্য কোনো দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার একমাত্র লক্ষ্য শ্রীহরির সাক্ষাৎ লাভ করা।
বালক ধ্রুবের এই একাগ্রতা দেখে শ্রীহরির মন গলে গেল। তিনি ধ্রুবের কাছে এসে দেখা দিলেন। বললেন, ‘ধ্রুব, তোমার তপস্যায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। '
ধ্রুব ভক্তিভরে শ্রীহরিকে প্রণাম করল। শ্রীহরি বৈকুণ্ঠে ফিরে গেলেন। ধ্রুবও বাড়ি ফিরল। রাজা উত্তানপাদ দুহাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নিলেন। বড় হলে ধ্রুবকেই তিনি রাজা করলেন। মৃত্যুর পর ধ্রুবের স্থান হলো ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ স্থান ধ্রুবলোকে।
ধ্রুব উপাখ্যান থেকে আমরা এই নৈতিক শিক্ষা পাই যে, পিতা-মাতাকে শ্রদ্ধা করতে হবে। কারো সঙ্গে বিবাদ করা উচিত নয়। ভগবানকে ভক্তি করতে হবে। কোনো কিছু চাইলে একাগ্র মনে চাইতে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই তা লাভ করা যাবে। এ শিক্ষা আমরা সবসময় মনে রাখব এবং জীবনে পালন করব।
১। বিভিন্ন মুনি-ঋষি ___ বাণীসমূহ দর্শন করেছেন।
২। ___ শুধু ব্রহ্ম সম্পর্কে আলোচানা করা হয়েছে।
৩। ___ বেদভিত্তিক হিন্দুধর্ম ও সমাজের নানা কথা বলা হয়েছে।
৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ___ একটি অংশ ।
৫। ___ শুনে বনের পশুরাও হিংসা ভুলে গেল ৷
১। বেদের এক নাম ২। বৃহদারণ্যক একটি ৩। দুর্গার বর্ণনা আছে ৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অমরত্বের ৫। ধ্রুবের একমাত্র লক্ষ্য ছিল | দেবী পুরাণে । কথা বলা হয়েছে। আত্মার। উপনিষদ। শ্রীহরির সাক্ষাৎ লাভ । শ্রুতি। যোদ্ধার। |
১। বেদের এক নাম শ্রুতি হলো কেন?
২। আরণ্যক কী? দুটি আরণ্যকের নাম লেখ ।
৩। মূল পুরাণ কয়খানা? দুটি মূল পুরাণের নাম লেখ ৷
৪। গীতা কী?
৫। উত্তানপাদের কয়জন স্ত্রী ছিলেন? তাঁদের নাম লেখ ।
১। চার বেদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
২। ব্রাহ্মণ কী? সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
৩। উপনিষদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।
৪। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা কর ।
৫। ধ্রুব কীভাবে হরিকে পেল ?
জগতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ জন্মগ্রহণ করেন। কেউ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউবা অপরের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেন। এঁরা হন নির্মোহ। পরের কল্যাণ, জগতের কল্যাণই এঁদের একমাত্র লক্ষ্য। আজীবন এঁরা মানুষ তথা জগতের উপকার করে যান। এঁরাই হলেন মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারী। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে আমরা এমনি কয়েকজন মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারীর জীবনী পড়েছি। এই শ্রেণিতে আমরা স্বামী প্রণবানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার জীবনী পড়ব।
মাদারীপুর জেলার বাজিতপুর গ্রামে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জানুয়ারি স্বামী প্রণবানন্দ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিষ্ণুচরণ ভূঁইয়া, মাতা সারদা দেবী। তাঁদের চার পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। প্রণবানন্দ তাঁদের তৃতীয় সন্তান। তাঁর প্রকৃত নাম বিনোদ। বিনোদের পিতা বিষ্ণুচরণ রাজা সূর্যকান্ত রায়ের অধীনে বাজিতপুর জমিদারির নায়েবের পদে চাকরি করতেন।
বিনোদ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন শিবের ভক্ত। তখন থেকেই তিনি ওঙ্কার সাধনার অভ্যাস করেন ।
বিনোদ বাজিতপুর গ্রামের উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন। তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিনোদের উপর তার প্রভাব পড়ে। তিনি পড়াশুনায় মন দিতে পারেন না। তারপরও ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন।
তখন গ্রামে-গঞ্জে হরি সংকীর্তনের প্রচলন ছিল খুব বেশি। বিনোদ কীর্তন খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি বন্ধুদের নিয়ে একটি কীর্তন দল গঠন করেন।
বিনোদ নিজে ছিলেন খুব সংযমী ও পরিশ্রমী। তাই বন্ধুদেরও তিনি সংযম ও ব্রহ্মচর্য পালনের আহ্বান জানান। বিনোদ তাদের নিয়ে আশ্রম গড়ে তোলেন। বাজিতপুরে এই আশ্রম খুব পরিচিত হয়ে ওঠে। আর বিনোদের পরিচয় হয় তপস্বী ব্রহ্মচারী হিসেবে।
তখন স্বদেশী আন্দোলন খুব জোরদার হয়ে উঠেছে। মাদারীপুর ছিল বিপ্লবীদের একটি বিখ্যাত কেন্দ্র। বিপ্লবী পূর্ণদাস ছিলেন এ অঞ্চলের নেতা। তিনি বিনোদের সংগঠনশক্তির কথা শুনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। বিনোদও এগিয়ে আসেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংঘবদ্ধ করার জন্য। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলা থেকে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ছেলেরা আসতে থাকে বিনোদের আশ্রমে। ক্রমে ব্যাপারটি চারদিকে প্রচারিত হয়ে যায়। তাই ব্রিটিশ পুলিশ একদিন বিনোদকে গ্রেফতার করে। পরে অবশ্য কোনো প্রমাণ না পেয়ে ছেড়ে দেয়।
এর কিছুদিন পরে বিনোদের পিতার মৃত্যু ঘটে। মায়ের আদেশে তিনি যান গয়াধামে পিণ্ড দিতে। কিন্তু সেখানে তীর্থযাত্রীদের উপর পাণ্ডাদের অত্যাচার দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন। তিনি সংকল্প করেন হিন্দুদের তীর্থসমূহ সংস্কার করা হবে তাঁর প্রথম ও প্রধান কাজ। এর জন্য সংঘশক্তি প্রয়োজন ।
গ্রামে ফিরে বিনোদ মাদারীপুর, বাজিতপুর, খুলনা প্রভৃতি স্থানে সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এসবের মাধ্যমে গরিব-দুঃখী, আর্ত-পীড়িতদের সেবা দিতে থাকেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দুঃসময়ে তিনি সেবাশ্রমের কর্মীদের নিয়ে মানুষের সেবা করে চলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বিনোদ পাঁচশত কর্মী নিয়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেন। তাঁর এ কাজে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় খুবই খুশি হন এবং তাঁর উচ্চ প্রশংসা করেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রয়াগে অর্ধকুম্ভ মেলা বসে। বিনোদ সেখানে যান। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় স্বামী গোবিন্দানন্দ গিরি মহারাজের। বিনোদ তাঁর নিকট সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষা নেন। তখন তাঁর নতুন নাম হয় স্বামী প্রণবানন্দ। এ সময় তিনি গৈরিক বেশ ধারণ করেন।
এবার স্বামী প্রণবানন্দ দৃষ্টি দিলেন তীর্থভূমির দিকে। তীর্থসমূহের পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তীর্থযাত্রীরা যাতে তীর্থে গিয়ে স্বচ্ছন্দে পুণ্যকর্ম করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। গয়ায় পাণ্ডাদের অত্যাচারের কথা তিনি আগেই জানতেন। তাই সেখানেই তিনি আগে গেলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন সেবাশ্রম। এই সেবাশ্রমই পরবর্তীকালে ‘ভারত সেবাশ্রম’ নামে সারা ভারতে খ্যাতি লাভ করে।
প্রণবানন্দের এ কাজে অনেক বাধা এসেছিল। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে তিনি এগিয়ে চলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি কাশী, প্রয়াগ, বৃন্দাবন, কুরুক্ষেত্র প্রভৃতি স্থানে ভারত সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার সেবা প্রদান করতে থাকেন। তীর্থযাত্রীরা যাতে নির্বিঘ্নে তাঁদের ক্রিয়া-কর্ম করতে পারেন, তার ব্যবস্থা করেন। এর ফলে তীর্থস্থানসমূহের চেহারা পাল্টে যায় ৷
স্বামী প্রণবানন্দ অস্পৃশ্যতাকে ঘৃণা করতেন। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাব জাগিয়ে তোলার কথা বলতেন। সকলের মধ্যে সহযোগিতার ভাব গড়ে তোলার কথা বলতেন। এজন্য মিলন-মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলতেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের বলতেন : তোমরা সনাতন আদর্শে সংগঠিত হয়ে আর্য ঋষিদের আসনে উপবেশনপূর্বক এই অধঃপতিত দেশকে নীতি ও ধর্মের পথে চালিত করবে। আহারে, বিহারে ও আলাপে সংযম অভ্যাস করবে। দুর্বল ব্যক্তি আত্মজ্ঞান ও ভগবদ্ভক্তি লাভ করতে পারে না। সংঘ, সংঘশক্তি ও সংঘনেতা এই তিনে মিলে হয় এক ।
স্বামী প্রণবানন্দ ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বাজিতপুর আশ্রমে এক হিন্দু মহাসম্মেলনের আয়োজন করেন। তাতে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে। তারা স্বামীজীর বাণী শুনে নবজীবনের সন্ধান পায়। লক্ষ লক্ষ অনুন্নত শ্রেণির মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে মানসিক হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি লাভ করে।
মহাপুরুষ স্বামী প্রণবানন্দ মাত্র ৪৪ বছর ১১ মাস ৯ দিন বেঁচে ছিলেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারি কলকাতার বালিগঞ্জের ভারত সেবাশ্রম সংঘের বাড়িতে তিনি দেহত্যাগ করেন।
ভগিনী নিবেদিতা ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপের আয়ারল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল। তাঁর পিতা স্যামুয়েল ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক আদর্শবাদী মানুষ । তার মাতা মেরী ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণা নারী। পিতা-মাতার এসব গুণ মার্গারেটের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তাই বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে আদর্শ, নিষ্ঠা ও ধর্মপ্রবণতা লক্ষ করা যায় ।
মার্গারেট শৈশবে পিতৃহীন হন। তাঁর পিতা মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান। মার্গারেটের আরও এক বোন ও এক ভাই ছিলেন। মা মেরী তাঁদের সবাইকে নিয়ে পিতা হ্যামিলটনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানেই মার্গারেটের পড়াশোনা শুরু হয় ৷
মার্গারেট খুব প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন। স্কুল-কলেজের পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন। কলেজের পরীক্ষা শেষ করে তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন। অবসর সময়ে একটি চার্চের কর্মী হিসেবে জনসেবা করতেন। এর মধ্য দিয়ে অল্প বয়সেই তাঁর মধ্যে সেবার মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু একটি বিষয়ে চার্চের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মার্গারেটের মতবিরোধ দেখা দেয়। চার্চের নিয়ম ছিল যারা চার্চে এসে উপাসনা করবে, কেবল তারাই চার্চের সাহায্য পাবে। মার্গারেট এটা মানতে পারেননি। তাঁর মতে দুঃস্থ, নিপীড়িত সবাই চার্চের সুযোগ সুবিধা পাবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তা মানেননি। তাই মার্গারেট মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তিনি এই সংকীর্ণতা থেকে উদ্ধারের একটা পথ খুঁজছিলেন। এমন সময় তাঁর সাক্ষাৎ হয় স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে ৷
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে বিবেকানন্দ তখন বিশ্বখ্যাত। বিভিন্ন জায়গায় তিনি বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন আসেন। সেখানকার দার্শনিক ও ধর্মানুরাগীরা হিন্দুধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে বক্তৃতা শোনার জন্য তাঁর নিকট ছুটে আসেন। একদিন মার্গারেটও এলেন। তিনি স্বামীজীর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হন। বেদান্তের ধর্মমত তাঁকে শান্তি দেয়। তিনি স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
শুরু হয় মার্গারেটের নতুন জীবন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ভারতে চলে আসেন। স্বামীজী তখন ধর্মে-কর্মে ভারতকে নতুন চেতনা দানের মহান ব্রত গ্রহণ করেছেন ৷ মার্গারেট মনেপ্রাণে গুরুর কাজে সাহায্য করতে লাগলেন। কাজের প্রতি তাঁর আত্মনিবেদন দেখে স্বামীজী তাঁর নাম দেন ‘নিবেদিতা’। স্বামীজীর শিষ্যরা তাঁকে বলতেন ‘ভগিনী নিবেদিতা'। সেই থেকে মার্গারেট ‘ভগিনী নিবেদিতা' নামেই খ্যাত হন।
একজন বিদেশিনী হয়েও নিবেদিতা ভারতবাসীদের একান্ত আপন করে নিয়েছিলেন। ভারতবাসীদের সেবায় তিনি তাঁর সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছিলেন। গুরুর নির্দেশে তিনি কলকাতার বাগবাজারে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তাঁর শিক্ষা-পদ্ধতি ছিল চিত্তাকর্ষক। তিনি গল্পের ছলে ছাত্রীদের শিক্ষা দিতেন। রামায়ণ-মহাভারত থেকে সীতা, সাবিত্রী, গান্ধারী প্রভৃতি মহীয়সী নারীদের জীবনী খুব যত্নসহকারে তাদের শেখাতেন। এছাড়া নানাভাবে তিনি এদেশের গরিব-দুঃখীদের সেবা করতেন।
ভারতকে ভগিনী নিবেদিতা ‘ধাত্রী দেবতা’ রূপে গ্রহণ করেছিলেন। তাই পরাধীন ভারতের দুঃখ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কার দেখে তাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে। তিনি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের কথা ভাবতে থাকেন। তখন ভারতের মুক্তির জন্য যাঁরা সংগ্রাম করতেন, তিনি তাঁদের উৎসাহ দিতেন এবং সাহায্য করতেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বারাণসীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসে তিনি বিলেতি দ্রব্য বর্জনের জোরালো আহ্বান জানান। ভারত ও তার জনগণের জন্য তাঁর এই মমতা দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘লোকমাতা।’
ব্যক্তিজীবনে নিবেদিতা ছিলেন ভারতীয় নারী-জীবনের প্রতীক। তিনি নিষ্ঠাবতী ব্রহ্মচারিণীরূপে জীবনযাপন করতেন। তাঁর লেখা ‘কালী, দ্য মাদার’, ‘দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম' প্রভৃতি গ্রন্থে ভারতের প্রতি তাঁর অনুরাগ ও গুরুর প্রতি শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায়।
নিচের ছকটি পূরণ করি :
১। মার্গারেট এলিজাবেথের নাম হয় | |
২। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মার্গারেটের নাম দিয়েছিলেন |
নিবেদিতা দেশের কাজ ও গ্রন্থ রচনায় কঠোর পরিশ্রম করতেন। ফলে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি দার্জিলিং যান। সেখানেই ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে এই মহীয়সী নারীর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর স্মৃতিস্তম্ভে লেখা আছে :
এখানে ভগিনী নিবেদিতা শান্তিতে নিদ্রিতা
যিনি ভারতবর্ষকে সর্বস্ব অর্পণ করেছেন।
ভগিনী নিবেদিতার জীবনী থেকে আমরা এই নৈতিক শিক্ষা পাই যে, যাঁরা মহীয়সী নারী তাঁরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মানব সেবার জন্য তাঁদের জন্ম। তাই তাঁরা শুধু দেশের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেন না। গোটা বিশ্বই তাঁদের দেশ। সকল মানুষই তাঁদের আপন। মানব সেবাই হচ্ছে তাঁদের মূল লক্ষ্য।
আমরা এই শিক্ষা সর্বদা মনে রাখব এবং আমাদের জীবনে অনুসরণ করার চেষ্টা করব।
১। যাঁরা আজীবন জগতের উপকার করে যান, তাঁরাই হলেন ___ ও মহীয়সী নারী ।
২। মাদারীপুর ছিল ___ একটি বিখ্যাত কেন্দ্র ।
৩। স্বামী প্রণবানন্দ প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের নাম ___।
৪। মার্গারেটকে শান্তি দেয় ___ ধর্মমত।
৫। রবীন্দ্রনাথ মার্গারেটের নাম দিয়েছিলেন ___।
১। মহাপুরুষ ও মহীয়সী নারীদের ২। বিনোদ ছিলেন খুবই ৩। স্বামী প্রণবানন্দ ৪। মার্গারেটের পিতা স্যামুয়েল ছিলেন ৫। ভগিনী নিবেদিতা দার্জিলিং যান | সংযমী ও পরিশ্রমী। একমাত্র লক্ষ্য জগতের কল্যাণ। একজন ধর্মপ্রচারক। অস্পৃশ্যতাকে ঘৃণা করতেন। জীবনী সুন্দর। সাহসী ও শক্তিমান। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য । |
১। বিনোদের পিতা বিষ্ণুচরণ ভূঁইয়া কী করতেন ?
২। বিনোদ কেমন ছিলেন? তিনি বন্ধুদের নিয়ে কী করেছিলেন ?
৩। বিনোদের নাম ‘স্বামী প্রণবানন্দ’ হয় কখন এবং কীভাবে?
৪। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বিনোদের প্রশংসা করেছিলেন কেন?
৫। চার্চের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মার্গারেটের বিরোধ বাধে কেন?
১। বিনোদকে কেন ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করেছিল ?
২। তীর্থস্থানে পাণ্ডাদের অত্যাচার বন্ধে বিনোদ কী করেছিলেন ?
৩। বিবেকানন্দের সঙ্গে মার্গারেটের সাক্ষাৎ হয় কখন এবং কীভাবে?
৪। নারীশিক্ষার জন্য নিবেদিতা কী করেছিলেন ?
৫। ভারতের স্বাধীনতার জন্য নিবেদিতা কী করেছিলেন?
আরও দেখুন...